মন্ত্রিসভায় প্রস্তাবিত ‘সাইবার নিরাপত্তা আইন, ২০২৩’ তথা সিএসএর খসড়ার চূড়ান্ত অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। সরকার আইনটির নীতিগত অনুমোদনের পর অংশীজনের মতামত নেওয়ার কথা বললেও তেমন কোনো উদ্যোগ আমরা দেখিনি। বিতর্কিত এই প্রস্তাবিত আইনের খসড়া চূড়ান্ত অনুমোদনের পর নির্বাচনের আগে জাতীয় সংসদের আগামী অধিবেশনেই হয়তো পাস হতে যাচ্ছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের স্থলে এভাবে তড়িঘড়ি করে প্রণীত নতুন এ আইন নাগরিকের হয়রানি কমাবে না। আমরা দেখেছি, ২০১৮ সালে একইভাবে নির্বাচনের আগে পাস হয়েছিল ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন। তারও আগে ছিল তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি আইন-আইসিটি অ্যাক্ট। এই অ্যাক্টের ৫৭ ধারায় প্রথম মামলার প্রথম আইনজীবী ছিলাম আমি। ২০১৩ সালের এপ্রিলে চারজন ব্লগারের বিরুদ্ধে ৫৭ ধারায় মামলা এবং তাদের গ্রেপ্তার করা হয়।

 

বস্তুত আইসিটি আইনের ৫৭ ধারাটি ছিল বিতর্কিত। কারণ সেখানে সাতটি বিষয়ের কথা বলা হয়– ‘মানহানি’, ‘মিথ্যা-অশ্লীল’, ‘আইনশৃঙ্খলার অবনতি’ ও ‘ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত’, ‘নীতিভ্রষ্ট বা অসৎ হতে উদ্বুদ্ধ’ এবং ‘রাষ্ট্র ব্যক্তির ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন’। এ বিষয়গুলোকে আইনে সেভাবে ব্যাখ্যা করা হয়নি। আইনত কোনো ফৌজদারি অপরাধের ক্ষেত্রে একেবারে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ থাকতে হয়। ৫৭ ধারায় আইনের ক্ষেত্রে এমন কিছু সুনির্দিষ্টভাবে সংজ্ঞায়িত ছিল না। ধরুন, ‘যদি কেউ রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করে’। রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন বলতে কী বোঝায়, তা কিন্তু বাংলাদেশের কোনো আইনে বলা নেই। এর মানে, আপনি একটা বড় জাল ফেলবেন, যেখানে এ আইনের দ্বারা দোষী ব্যক্তি যেমন ধরা পড়বে, তেমনি নিরপরাধ ব্যক্তিও হয়রানির শিকার হবে। এসব কারণে ৫৭ ধারায় আইনের নামে বেআইনি কাজ করার সুযোগ হয়েছে। আইনটির বিরুদ্ধে সে কারণেই সাধারণ নাগরিক, সাংবাদিকসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ সোচ্চার হয়েছিল। তখন তিনটি রিট হয়। দুটো শুরুতেই বাতিল হয়। একটি মামলায় আমি আইনজীবী ছিলাম। সেটির রুল ইস্যু হয়। তার কার্যক্রম চলমান থাকা অবস্থায় আইনমন্ত্রী বলেছিলেন, আইনটি তারা বাতিল করবেন। এ কারণে সেটির শুনানিও হয়নি।

 

পরে আমরা দেখলাম, ২০১৮ সালে নির্বাচনের ঠিক আগ মুহূর্তে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন পাস হয়। তখন ৫৭ ধারা বাতিল হলেও ওই ধারায় যে সাতটি উপাদান ছিল, সেগুলোকে যথাযথভাবে সংজ্ঞায়িত না করে আবার নতুন আইনে চারটি ধারা সন্নিবেশিত করা হয়। ফলে ৫৭ ধারায় যেভাবে মানুষকে হয়রানি করা হতো, সেভাবে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের এ ধারাগুলোর মাধ্যমেও নিরপরাধ অনেক মানুষকে হয়রানি করা হয়। এখনও অনেক মানুষ জেলে। করোনার মধ্যে আদালত বন্ধ থাকা সত্ত্বেও এ ক’বছরে সাত হাজারের অধিক মামলা হয়েছে। এত মামলা হওয়ার কারণ হলো, এ আইনের মধ্যে যে কোনো কিছুকে অন্তর্ভুক্ত করা যায় এবং এতে সহজে জেলে ঢুকিয়ে দেওয়া সম্ভব হয়। জেলে একবার ঢোকাতে পারলে সহজে জামিন হয় না। এ মামলায় রায় হওয়ার নজির খুব কম। সাজা হয়েছে শূন্য দশমিক ৩ শতাংশ মামলার। যারা গ্রেপ্তার হন, তাদের বেশ হয়রানি করা যায়। যেমনটা আমরা জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী খাদিজার ক্ষেত্রে দেখেছি। সে কারণেই নাগরিকদের পক্ষ থেকে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিলের দাবি ওঠে। কেউ কেউ প্রথমে আইনটি সংশোধনের কথা বললেও পরবর্তী সময়ে সবাই বাতিলের দাবি জানান।

 

আমরা দেখছি, নাগরিকদের পক্ষ থেকে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের বিরুদ্ধে জোর প্রতিবাদের মুখে সরকার ওই আইন বাতিল করে নতুন মোড়কে ‘সাইবার নিরাপত্তা আইন, ২০২৩’ নামে আগামী সংসদ অধিবেশনে উত্থাপনের পরিকল্পনা করছে। যেসব কারণে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিল করার কথা, সেসব কারণ বিদ্যমান রেখে শুধু শাস্তির ধারার আংশিক পরিবর্তন করে যদি রেখে দেওয়া হয়, তাহলে বাতিল করার দাবি সত্য নয়।

 

সাইবার নিরাপত্তা আইনের যে খসড়া প্রকাশ করা হয়েছে তাতে দেখা যায়– ধারা ১৮(১)(খ), ২০, ২২, ২৩, ২৪, ২৫, ২৬, ২৮, ২৯, ৩১, ৩২ ও ৪৬কে জামিনযোগ্য করা হয়েছে। আগের আইনের সঙ্গে মিল আছে এমন ধারা যেমন– ধারা ১৭, ১৯, ২৭ ও ৩৩ এখনও অজামিনযোগ্য থাকছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে করা মামলাগুলো বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, ওই আইনে শুধু জামিনযোগ্য ধারায় কোনো মামলা হয়নি। জামিন যাতে না পায়, তাই জামিন অযোগ্য ধারা একটি হলেও জুড়ে দেওয়া হয়। নতুন আইনের ক্ষেত্রেও একই ধারাবাহিকতা চলমান থাকবে।

 

এক বছর ধরে আটক জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী খাদিজার বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ২৫, ২৯, ৩১ ও ৩৫ ধারায়। ২৫ ও ২৯ জামিনযোগ্য, ৩১ ও ৩৩ অজামিনযোগ্য। এ অবস্থায় নতুন আইনের প্রয়োজন কী? নতুন আইনের নাম হচ্ছে ‘সাইবার নিরাপত্তা আইন’। অথচ এ আইনে সাইবার অপরাধের সংজ্ঞায়ন করা হয়নি। সাইবার অপরাধের ধরন, কারা এ অপরাধ করতে পারে, সাইবার অপরাধের টার্গেট কারা এবং সাইবার অপরাধীদের কীভাবে ডিল করা হবে, সেগুলো থাকার কথা। সাইবার আক্রমণ হলো কম্পিউটার সিস্টেমের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ নেওয়া বা হ্যাক করা। র‍্যানসমওয়্যারের মাধ্যমে এর পর তারা মুক্তিপণ দাবি করে। যেমন ধরুন, একজন হ্যাকার রেলওয়ে সিস্টেমকে কবজা করে একশ কোটি টাকা দাবি করল। পশ্চিমা বিশ্বে এটা অনেক বড় হুমকি। কারণ সিস্টেম দখল করলে এমনকি একটা ট্রেনের সঙ্গে আরেকটি ট্রেনের সংঘর্ষ বাধিয়ে শত শত মানুষ হত্যার ঘটনাও ঘটতে পারে। এখন যেহেতু অনলাইনে সব হচ্ছে, সে জন্য সেখানকার অপরাধ নিয়ন্ত্রণে আইন হতে পারে। আমাদের সাইবার নিরাপত্তা আইনে এসব মারাত্মক অপরাধের কথা কই? সাইবার বুলিং, সাইবার স্টকিং, সফটওয়্যার পাইরেসি, সোশ্যাল মিডিয়া ফ্রড– এগুলোও আসেনি। ইলেকট্রনিক মানি লন্ডারিংয়ের কথা এলেও সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা নেই। এর বিপরীতে আমরা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের সেই পুরোনো বোতলে নতুন মদ দেখছি।

এর অর্থ, সেই ভীতি, শঙ্কা, নিয়ন্ত্রণ, স্বাধীনভাবে কাজ করতে না পারা, মতপ্রকাশে বাধা থাকছেই। একই সঙ্গে এমন আইন মানুষের জীবনও কেড়ে নিচ্ছে। আগের আইনে আটক লেখক মোশতাক জেলেই মারা গেলেন। খাদিজার মতো অনেকের জীবনের মূল্যবান সময়ও নষ্ট হচ্ছে। খাদিজার বিশ্ববিদ্যালয়ের দুটি সেমিস্টার চলে গেল। সে কবে বের হবে; বের হলেও তার জীবনে কী হবে, সে অনিশ্চয়তা রয়েই গেছে। এটি জীবনের অনেক বড় ক্ষতি।
সর্বশেষ আমি বলব, সাইবার নিরাপত্তা আইন তড়িঘড়ি করে পাস করা উচিত হবে না। সাংবাদিকসহ এ আইনের অংশীজন যারা রয়েছেন, যেসব পেশার মানুষ কিংবা যারা এ আইন দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন; তাদের সঙ্গে আলোচনা করে সময় নিয়ে আইনটা করা উচিত ছিল। নির্বাচন যেহেতু সামনে; নির্বাচিত নতুন সরকারের সময়েই এটা করা উচিত। একই সঙ্গে প্রকৃত অর্থেই সাইবার অপরাধই হওয়া উচিত এই আইনের ফোকাস বা নিশানা। তা না করে নাগরিক হয়রানির নতুন আয়োজন প্রত্যাশিত নয়।

 

ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া: বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ও অধিকার কর্মী